চাকমাদের উৎসব, ভাষা, খাবার, জনসংখ্যা, ধর্ম এবং চাকমা পরিবারের প্রধান সম্পর্কে জানুন

চাকমাদের উৎসব, ভাষা, খাবার, জনসংখ্যা, ধর্ম এবং চাকমা পরিবারের প্রধান সম্পর্কে জানুন
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে বৃহৎ আদিবাসী গোষ্ঠী হলো: চাকমা। চাকমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, ভাষা, পোশাক, ধর্ম এবং খাদ্যাভ্যাস তাদের আলাদা পরিচিতি দিয়েছে।

চাকমারা শত শত বছর ধরে বাঙালি সংস্কৃতির পাশাপাশি নিজেদের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। চলুন জেনে নেওয়া যাক, চাকমাদের উৎসব, ভাষা, প্রধান খাবার ও সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য।

চাকমাদের উৎসবের নাম কি

চাকমাদের প্রধান এবং সবচেয়ে বড় উৎসব হলো: বিজু। বিজু নামক এই উৎসবটি বাংলা বছরের শেষ দুই দিন এবং নতুন বছরের প্রথম দিনে পালন করা হয়। বিজুর তিনটি দিনকে আলাদা আলাদা নামে ডাকা হয়—ফুল বিজু, মূল বিজু এবং গয্যে পয্যে।

প্রথম দিনে ফুল দিয়ে ঘর সাজানো হয়, বয়স্কদের গোসল করানো হয় এবং নতুন কাপড় পরানো হয়। দ্বিতীয় দিনে নানা রকম সবজি মিশিয়ে 'পাচন' রান্না করা হয়, যা বিজুর অন্যতম ঐতিহ্যবাহী খাবার।

তৃতীয় দিনে চাকমারা বৌদ্ধ মন্দিরে গিয়ে পূজা করে, দান করে এবং ভালো কাজের মাধ্যমে নতুন বছর শুরু করে। এই উৎসব সামাজিক মিলনমেলাও বটে, যা চাকমাদের সংস্কৃতির প্রাণ।

চাকমা জনগোষ্ঠীর ভাষার নাম কি

চাকমারা যে ভাষায় কথা বলেন, সেটি হলো: চাকমা ভাষা বা চাংমা ভাজ। এটি পূর্ব ইন্দো-আর্য ভাষা পরিবারের অংশ এবং চাকমা লিপিতে লেখা হয়। এই ভাষায় সংস্কৃত, পালি ও চট্টগ্রামের স্থানীয় উপভাষার প্রভাব দেখা যায়।

চাকমা ভাষা চাকমাদের পরিচয়ের একটি প্রধান নিদর্শন এবং তাদের সাহিত্যে যেমন উবগীদ, তেমনি ধর্মীয়, সামাজিক ও দৈনন্দিন জীবনেও এই ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম।

চাকমাদের প্রধান খাবার কি

চাকমাদের প্রধান খাদ্য হলো: ভাত। পাশাপাশি তারা বাঁশের কচি অঙ্কুর, যাকে 'বাচ্ছুরি' বলা হয়, তা দিয়ে নানা ধরনের খাবার তৈরি করে। এছাড়া 'সিদোল' বা চিংড়ি পেস্ট তাদের রান্নায় একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

শাক-সবজি, সরিষা, ভুট্টা এবং শুকরের মাংস তাদের খাদ্য তালিকায় উল্লেখযোগ্য। চাকমারা বিশেষ ভাবে 'নাপ্পি' নামের একটি গাঁজনযুক্ত খাবার পছন্দ করে।

চাকমাদের ধর্ম কি

চাকমাদের অধিকাংশই অনুসরণ করে থেরবাদী বৌদ্ধ ধর্ম। তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, উপাসনা, দান-ধ্যান প্রথা বৌদ্ধ ধর্মীয় রীতিনীতির সাথে মিশে আছে। আগে হিন্দু দেব-দেবীর পূজাও চলত, কিন্তু বর্তমানে বনভন্তের প্রভাবে বৌদ্ধ ধর্মে কুসংস্কারের প্রভাব অনেকটাই কমে এসেছে। চাকমারা বিশ্বাস করেন, তাঁরা গৌতম বুদ্ধের সাক্যবংশের অংশ।

বাংলাদেশে চাকমা জনসংখ্যা

বাংলাদেশে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে চাকমাদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, চাকমাদের সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ ৮৩ হাজার ২৯৯। এই সংখ্যাটি তাদের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক গুরুত্বকে তুলে ধরে। সংখ্যার দিক দিয়ে মারমা ও ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠী পরবর্তী স্থানে রয়েছে।

চাকমা পরিবারের প্রধান কে

চাকমা সমাজ পিতৃতান্ত্রিক। অর্থাৎ, পরিবারে পিতা প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর পরে পরিবারের সিদ্ধান্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে মা ও জ্যেষ্ঠপুত্রের। কয়েকটি পরিবার মিলে ‘আদাম’ বা ‘পাড়া’ গঠিত হয় এবং এর প্রধানকে বলা হয় কার্বারি।

কয়েকটি পাড়া নিয়ে তৈরি হয় মৌজা, যার প্রধান হলেন হেডম্যান। আবার কয়েকটি মৌজা মিলে একটি সার্কেল, যার প্রধান হন চাকমা রাজা। এই শাসনব্যবস্থা বংশানুক্রমিক এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের সামাজিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

উপসংহার

চাকমা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে যেমন বৈচিত্র্য এনে দিয়েছে, তেমনি নিজেদের ইতিহাস, ধর্ম, ভাষা ও উৎসব নিয়ে গর্ব করবার মতো একটি জাতিগোষ্ঠী। বিজু উৎসব, চাকমা ভাষা ও বাচ্ছুরি-পাচনের মতো খাদ্য তাদের সংস্কৃতিকে করে তোলে অনন্য। চাকমাদের সম্পর্কে জানলে বোঝা যায়, এই জনগোষ্ঠী আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যের একটি গৌরবময় অংশ।
এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন
পূর্বের আর্টিকেল দেখুন পরবর্তী আর্টিকেল দেখুন
এখনো কোনো মন্তব্য করা হয়নি
মন্তব্য করুন
comment url



আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেল জয়েন করুন
হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল জয়েন করুন